শেখ হাসিনা মেডিক্যালের কাজে বাঁশের সাটারিং, দুর্ঘটনার আশঙ্কা

শেখ হাসিনা মেডিক্যালের কাজে বাঁশের সাটারিং, দুর্ঘটনার আশঙ্কা জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প।

আমার বাংলা টিভি ডেস্ক : ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাদ ধসে এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন আরও পাঁচজন।
মূলত ছাদ ঢালাইয়ের সময় স্টিলের পরিবর্তে বাঁশের সাটারিং ব্যবহার করার কারণেই ওই দুর্ঘটনা ঘটে। এবার একইভাবে জামালপুরে নির্মাণাধীন শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেও স্টিলের পরিবর্তে বাঁশের সাটারিং ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এখানেও যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণের খসড়া প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। শুরু থেকেই এ প্রকল্পে নানা ধরনের অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া গেছে।

জানা যায়, ২০১৬ সালে ৭১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হলেও এখনও এর মূল নির্মাণ কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পের মূল কাজ ছিল ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট শেখ হাসিনা হাসপাতাল নির্মাণ করা। এর বাইরে যেটুকু নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যেই হয়েছে তাতেও নানা ধরনের অসঙ্গতি পাওয়া গেছে।

হাসপাতালে স্টিলের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশের সাটারিং। রয়েছে যোগ্য প্রকৌশলীর অভাব। স্ট্রাকচারাল নকশা তৈরিতে বিলম্বসহ সাব কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে কাজ বাস্তবায়নের ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালকের ঘাটতির কারণে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও দুর্বল। বেশিরভাগ সময়ই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকারী এর পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। এ বাদে যথাসময়ে জনবল নিয়োগ না করায়ও প্রকল্পের গতি কম ছিল। এ প্রকল্পে ২৮০ কোটি টাকা ভারতীয় ঋণ ব্যবহার করা হয়েছে।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরে এই প্রকল্পের আওতায় অন্যান্য কাজ যেমন- একাডেমিক ভবন, শিক্ষার্থীদের হোস্টেল, অন্যান্য আবাসিক ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হলেও প্রধানমন্ত্রীর নামে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের কাজ এখনও শুরুই হয়নি। এর কারণ খুঁজতে কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের আওতায় ৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য আড়াইশ’ কোটি টাকার বাজেট ভারতীয় ঋণ থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে যত কাজ হয়েছে, সবই রাষ্ট্রীয় খরচে।

ভারতীয় ঋণ প্রাপ্তির ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় ঋণের টাকা পাওয়া কঠিন। ঠিকাদার নিয়োগে জটিলতা দেখা দেয়। ঠিকাদার নিতে হয় ভারত থেকে। পণ্য ও সেবাও আনতে হয় ওই দেশ থেকে। এসব কারণে এখন পর্যন্ত হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। ফলে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৯৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। amarbangla.tv

প্রকল্প পরিদর্শনে নানা অসঙ্গতির প্রসঙ্গ তুলে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-৫-এর (স্বাস্থ্য ও গৃহায়ন) পরিচালক কাজী দেলোয়ার হোসেন বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এ প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সরেজমিনে গিয়ে দেখি, এতে স্টিলের পরিবর্তে বাঁশের সাটারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পরে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনি। এছাড়া ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছি। আমরা প্রকল্পটি নিয়ে এরইমধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এটা সংশ্লিষ্টদের হাতে পৌঁছে দেবো।

প্রকল্পের মূল কাজ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের কাজ এখনো শুরুই হয়নি। শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের আওতায় ৫০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ করা আড়াইশ’ কোটি টাকা রাখা হয়েছে ভারতীয় ঋণ থেকে। কিন্তু ভারতীয় ঠিকাদার এই টাকার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ প্রতিবছর গুরুত্বপূর্ণ চলমান প্রকল্প নির্বাচন করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগকৃত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পরিবীক্ষণ করে থাকে। তথ্য সংগ্রহের জন্য সরেজমিন মাঠ পরিদর্শন, ভৌত অবকাঠামো যাচাইকরণ, নির্মাণ কাঠামোর গুণগত মান পরীক্ষা, ক্রয় সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা এবং প্রকল্প ঘিরে স্থানীয়ভাবে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সার্বিক জায়গা থেকেই শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অসঙ্গতি দেখা গেছে। amarbangla.tv

ভারতীয় ঋণ সহায়তার শর্তানুযায়ী প্রকল্পের কিছু কিছু কাজে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। শর্তানুযায়ী অংশগ্রহণ করার জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হয়। দরপত্র আহ্বানের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে এখন পর্যন্ত মোট ৫ বার এ সংক্রান্ত সংশোধন করা হয়। ফলে আহ্বানের পর দরপত্র গ্রহণে বিলম্ব হয়।

সূত্র জানায়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণেও এ প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল ডিপিপি গণপূর্ত অধিদপ্তরের শিডিউল ২০১৪ অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়েছিল। সংশোধিত ডিপিপি রেট শিডিউল ২০১৮ মোতাবেক প্রস্তুত করা হয়। এতে যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের সার্বিক ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুযায়ী প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৬৭.৫২ শতাংশ নির্মাণ বাবদ ৬৪১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা খরচ হয়। এছাড়া ২৭.২২ শতাংশ বরাদ্দ যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কিনতে খরচ হয়েছে। এ খাতে মোট খরচ হয়েছে ২৫৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এছাড়া বাকি টাকা ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ খরচ হয়েছে। প্রকল্পটি ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের আর্থিক সহায়তায় হওয়ায় বাস্তবায়ন কাজ বিলম্ব হয়। ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এর মেয়াদ জুন ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমে প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৭১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৯৫০ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ আছে ২৮০ কোটি টাকা। amarbangla.tv

প্রতিবেদন সূত্রে আরো জানা যায়, এ প্রকল্পের শুরু থেকেই নিয়মিত ও পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক অনুপস্থিত ছিলেন। ৪ মাস ১৩ দিন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ। এ ছাড়া দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে প্রকল্প পরিচালনার দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ না দেওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সার্বিকভাবে ব্যাহত হয়েছে।

আইএমইডির এ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপ-প্রধান (স্বাস্থ্য) মো. মজিবুর রহমান বলেন, বাঁশের সাটারিং ব্যবহারের মতো ঘটনা এর আগেও ঘটেছে কুষ্টিয়ায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ওই সময় ছাদ ধসে এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হন। আমরা তা নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করি এবং ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প নিয়ে আইএমইডির প্রতিবেদন এখনও হাতে আসেনি। এমন ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।

দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে উন্নত ও মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা জরুরি। এই লক্ষ্যে সরকার পর্যায়ক্রমে সব জেলায় মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে সারা দেশে ৬টি মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে জামালপুরে শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন অন্যতম। শেয়ার করুন।