চসিক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সবুরের আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন প্রকৌশলীরা 

 

 

সবুর খান। 

আমার বাংলা টিভি ডেস্কঃ সাধারণত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অধীনস্থ কর্মচারীদের শাসান বলে মাঝে মাঝে শোনা যায়। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) ঘটেছে উল্টো ঘটনা। এখানে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রায়ই শাসান। তার কথামতো প্রকৌশলীরা না চললেই শাসান। ওই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বিরুদ্ধে একাধিক কর্মকর্তাকে ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং চসিক মেয়রের কাছে অভিযোগ দিলেও তার কোন শাস্তি হয় না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়রের দফতরে জমা পড়া একটি অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

গত ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) বিদ্যুৎ উপ-বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী এনামুল হক মেয়রের কাছে সবুর খানের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। তিনি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, ‘গত ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের (চসিক) বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারী সবুর খান ওরফে মাসুম আমাকে মারধরের হুমকি দিয়েছে। ওই দিন প্রতিমা বিসর্জনের আলোকসজ্জা নিয়ে নগরীর দামপাড়াস্থ চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল বারীর কক্ষে আমি আলোচনা করছিলাম। এসময় সবুর খান এই হুমকি দেয়। এরপর গত ২ অক্টোবর বিকালে আমার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল দিয়ে ফের হুমকি দেয় সবুর খান।’

অধীনস্থ কর্মচারীর এমন আচরণে লজ্জিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন সহকারী প্রকৌশলী এনামুল হক। সবুরের আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। একপর্যায়ে তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ৩ অক্টোবর চসিক মেয়রের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী অভিযোগটি আমলে নিয়ে ১১ অক্টোবর একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলেন। বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে।

এনামুল হক বলেন, ‘চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বৈদ্যুতিক সহকারী সবুর খান আমাকে ক্ষুর ও ছুরি দিয়ে শরীর বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি দেয়। সবুর খান আমাকে কোথাও দেখলে বিভিন্নভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অপমানজনক কথা বলে। বারবার নিষেধ করার পর সে একই আচরণ করছে। আমি মামলা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে প্রথমে মেয়রের কাছে অভিযোগ দিতে বলেছেন। তাই অভিযোগ দিয়েছি। এরপর প্রতিকার না পেলে মামলা করবো।’

লিখিত অভিযোগপত্রে সহকারী প্রকৌশলী এনামুল হক জানান, ২০১২ সালের ৩ অক্টোবর দামপাড়াস্থ তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (বিদ্যুৎ) দফতরে সহকারী প্রকৌশলী রেজাউল বারীসহ অন্যান্যের উপস্থিতিতে তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে সবুর। ওই বছরের ৬ অক্টোবর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে কোতোয়ালী থানায় ধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন এনামুল হক। সেই সময় ওই ঘটনার প্রতিকার চেয়ে চসিকের তৎকালীন মেয়র বরাবরে আবেদন করা হলে তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে সবুর খান ক্ষমা প্রার্থনা করে। সবার অনুরোধে সবুর খানকে তিনি ক্ষমা করে দেন।

এ বিষয়ে সহকারী প্রকৌশলী এনামুল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘২০১২ সালে এই সবুর খান আমার গায়ে হাত তুলেছে। এখন আবার হুমকি দিচ্ছে। সবুর খান নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেজাউল বারীর শেল্টারেই এসব কর্মকাণ্ড করেছে। বৈদ্যুতিক হেলপার হলেও সবুর খান নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউলের পিএস হিসেবে কাজ করে।’

জানা গেছে, সবুর হেলপারের চাকরি করেন। তবে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে মিটার রিডার কাম বিল সহকারী হিসেবে ৪নং জোনে কাজ করেন। কিন্তু তিনি বেশি সময় দেন নির্বাহী প্রকৌশলীর দফতরে। কারণ, নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ও সবুর দূরসম্পর্কের আত্মীয়।

চসিকের কর্মচারী হয়েও ঠিকাদারি করেন সবুর খান

চসিকের অন্তত তিন থেকে চার জন প্রকৌশলী সবুর খানের হয়রানির শিকার হয়েছেন। চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়ায় সিটি করপোরেশনের বিদ্যুতের প্রধান কার্যালয়। এর কাছেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সবুর খানের বাসা। এখানেই তিনি কর্মরত। চসিকের বিদ্যুৎ বিভাগে কর্মরত সব প্রকৌশলী সেখানে যান। সবুর খান সিটি করপোরেশনের কর্মচারী হয়েও অন্যের লাইসেন্স দিয়ে ঠিকাদারি করেন। প্রকৌশলীদের কাজ থেকে কোটেশনে (সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি) কাজ নিয়ে থাকে। সাধারণত ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার কাজ তিনি জোর করে নিয়ে যান। প্রকৌশলীরা তাকে কাজ না দিলে বা না পেলেই খারাপ আচরণ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কোটেশনের ২ লাখ, ৩ লাখ , ৪ লাখ টাকার কাজ সবুর নিতে চায়। অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ফার্মের লাইসেন্স দিয়ে সে কাজ নেয়। সে কাজ না পেলেই প্রকৌশলীদের হয়রানি করে।’

চসিক’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী বলেন, ‘সবুর শ্রমিক সংগঠন করে, সে সবসময় দলবল নিয়ে করপোরেশনে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলে না। সবাইকে হুমকি ধমকি দেয়। অন্যের লাইসেন্স দিয়ে ঠিকাদারি করে। কাজ না পেলেই প্রকৌশলীদের বকাঝকা করে।’

হাজিরা দিয়ে বেতন নেয় সবুর খানের ভাই ও চাচা

 

সবুর খানের ভাই শাহিন খান ও চাচা দৌলত খান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে গাড়িচালক পদে কর্মরত। তবে তারা কেউ গাড়ি চালান না। গাড়ি চালান তাদের সহকারী বা বদলি চালকরা। মাঝে মাঝে পরিবহন বিভাগে হাজিরা দিয়ে বেতন নেন তারা। এছাড়াও তার চাচাতো ভাই যুবরুত খান বৈদ্যুতিক সহকারী পদে চাকরি করে।

চসিক’র পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সাবেক সম্পত্তি কর্মকর্তা আহমেদুর রহমানের গাড়ি চালাতো শাহিন খান। কিন্তু তিনি অবসরে যাবার পর শাহীন খান আর গাড়ি চালায়নি। মাঝে মাঝে এসে হাজিরা দেয়, গাড়ি চালায় অন্য মানুষ। তার চাচা দৌলত খানও গাড়ি না চালিয়ে, ডিউটি না করেই মাসের পর মাস বেতন নিচ্ছে।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরিবহন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল কাদেরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করবো না, এখন আমি আমার বসের সামনে আছি। পরে ফোন করে সব বলবো।’ তবে এরপর আর তিনি ফোন রিসিভ করেননি, নিজেও ফোন ব্যাক করেননি।

অভিযোগের বিষয়ে সবুর খান যা বললেন

সবুর খান চসিক জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক। বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত সবুর খান। তার প্রকৃত নাম সবুর খান হলেও তিনি মাসুম খান নামে ফেসবুক আইডি চালান। তার ফেসবুক আইডিজুড়ে রয়েছে সরকারবিদ্বেষী প্রচারণা।

প্রকৌশলীদের সঙ্গে অপেশাদার আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে বৈদ্যুতিক সহকারী সবুর খান বলেন, ‘প্রকৌশলীরা ঘুষ দুর্নীতি করলে, আমরা তার প্রতিবাদ করি, এজন্য তারা আমার বিরুদ্ধে কথা বলছে। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে এটি তদন্তের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন।’

২০১২ সালে ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, বিষয়টি সবুর খানের দৃষ্টিতে আনলে তিনি বলেন, ‘ওই সময় কথা কাটাকাটি হয়েছে। পরে সেটি মিটমাট হয়ে গেছে।’
এনামুল হকের অভিযোগটি তদন্ত করছেন চসিক’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মারুফা জামান। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে অভিযোগটি এসেছে। এখনও কোন পক্ষকে ডাকিনি। আমি কাজ করছি। শিগগিরই অগ্রগতি হবে।’ www.amarbangla.tv