কর্ণফুলী পাড়ের সেই অবৈধ বরফ কলকে বৈধতা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ: জনমনে ক্ষোভ

কর্ণফুলী পাড়ের সেই অবৈধ বরফ কলকে বৈধতা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ: জনমনে ক্ষোভ। 

আমার বাংলা টিভি ডেস্কঃ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে ফিশারীঘাট এলাকায় গড়ে উঠা একটি অবৈধ বরফ কল ও হিমাগারকে দুই বছর পর এসে বৈধতা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী নদী দুষণ ও দখলদারদের হাত থেকে রক্ষার জন্য বার বার উচ্ছেদ অভিযার পরিচালনা করে আসলেও দু’বছর আগে অবৈধ ঘোষণা দেয়া উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা বির্তকিত সেই বরফকলকে বৈধতা দেয়ায় বন্দরের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য, সরকারি বিধি-বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে মৎস্য অবতরণের পাশে সরকারি জায়গায় নির্মাণ করা বরফকলটি গত ২৭ এপ্রিল এক পত্রে বিভিন্ন শর্তে অনুমতি প্রদান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

কর্ণফুলী দখল করে অবৈধ বরফকল ও হিমাগার নির্মাণ চলছে। 

অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, কতিপয় একটি চক্র কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই-রাজাখালী খালের তীরে মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের পাশে বরফকল ও হিমাগার নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্ণফুলী নদীর তীরে স্থাপনা নির্মাণে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তা নির্মাণ করা হয়। সরকারি দলের শীর্ষ স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার ইন্ধনে এই মাছের বাজারটি নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরিবেশ জন্য ক্ষতিকর এই স্থাপনা তৈরী করছে প্রভাবশালী মহলটি। হিমাগার ও বরফকল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এনিয়ে মিডিয়াতে ব্যাপক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর জেলা প্রশাসক ও বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার জন্য একাধিকবার নোটিশ দেওয়া হয়। তারপর থেকে ছিল না অবৈধ দখল ও নির্মাণ কাজ। স্থানীয়রা অবৈধ মৎস বন্দরটি বন্ধ করে দিয়ে পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে নেয়ার দাবীকে অন্দোলন চালিয়ে আসছে।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লিঃ নামে একটি সংগঠন স্থানীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট বন্দর থানাধীন বাকলিয়া মৌজার বিএস খতিয়ান নং-১ (মালিক ডেপুটি কমিশনার, চট্টগ্রাম) এর বিএস দাগ নং ৮৬৫১ এর অধিনে চাকতাই ও রাজাখালী খালের মধ্যবর্তী সরকারী জায়গা ভরাট করে হাইকোর্টের অর্ডার অমান্য করে নতুন একটি পাইকারী মৎস্যবাজার নির্মাণ করে।

অথচ ২০১০ সালে কর্ণফুলী নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে নদীর সীমানা নির্ধারণ, দখল ভরাট, ও নদীতে যে কোন ধরণের স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার জন্য হাইকোর্টে রীট পিটিশন দাখিল করেন (রীট পিটিশন মামলা নং-৬৩০৬/২০১০ইং) মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি ও বিশিষ্ট আইনজীবি মনজিল মোরশেদ।

জেলা প্রশাসনের এক চিঠিতে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল জলিল হাইকোর্ট বিভাগের রিটের আদেশ মোতাবেক চাক্তাই ও রাজাখালী খালের তীরে উন্নয়ন, ফাইলিং, নির্মাণ কাজ, স্থায়ী ও অস্থায়ী অবকাঠানো সকল ধরনের কাজ বন্ধ এবং জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করে জেলা প্রশাসককে কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। পুলিশ কমিশনার, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ও মহানগরীর সদর সার্কেলের সহকারী (ভূমি) কমিশনারের কাছে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর সদর সার্কেলের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আছিয়া খাতুন একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে দেখা যায়, খাস খতিয়ানের ৮৬৫১ দাগের নদী (কর্ণফুলী নদী) শ্রেণি জমির কিছু অংশ ভরাট করে বাংলাদেশ জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। সমিতির পক্ষ থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জমি ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর ৮৬৫১ দাগ, চাক্তাই খালের ৮১৯৩ এবং রাজাখালী খালের ৬৪২৬, ৬৩৭৬ দাগ খাস খতিয়ানভুক্ত হিসেবে রেকর্ড রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের ইজারা বা ব্যবহারের অনুমতি প্রধান বোধগম্য নয়। খালসমূহে সকল ধরনের কাজ বন্ধ রাখার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে।

বন্দরের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বরফকল ও হিমাগার নির্মাণ কাজ বন্ধ করার জন্য নোটিশ জারি করেছিল। নোটিশে বলা হয়েছিল, চবক’র সংরক্ষিত জায়গায় অবৈধভাবে হিমাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। ৭ দিনের মধ্যে অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ ও নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অন্যথায় ইজারা গ্রহীতা ইজারা শর্ত ভঙ্গ করলে ইজারা বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। কিন্তু অবৈধ নির্মাণকারীরা ইজারাদাতা প্রতিষ্ঠান বন্দর কর্তৃপক্ষের নোটিশ অমান্য করে বরফকল ও হিমাগার নির্মাণ কাজ করেছিল। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বন্দর। শেষপর্যন্ত অবকাঠানো নির্মাণের দুই বছর পর সে অবৈধ হিমাগারকে দুই বছর পর রহস্যজনক কারণে বৈধতা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান স্বাক্ষরিত গত ২৭ এপ্রিলের অনুমতিপত্রের ২নং শর্তে দেখা যায়, ‘দাখিলকৃত নকশা অনুযায়ী প্রস্তাবিত হিমাগার ও বরফকল নির্মাণ করতে হবে। নকশাবহির্ভূত নির্মাণ করা হলে লাইসেন্স (অনুমতিপত্র) সরাসরি বাতিল করা হবে।’ ৬নং শর্তে দেখা যায়, পরিবেশ দূষণরোধ ও পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হবে।

দেখা গেছে- দুই বছর আগ থেকেই নির্মাণ কাজ চলে আসছে। ইতিপূর্বেই বরফকল ও হিমাগারের অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়ে গেছে। এমনকি বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য বিদ্যুতের খুঁটিও স্থাপন করা হয়েছে। অবৈধভাবে নির্মাণ প্রক্রিয়া শেষ করার পর এখন বৈধতা পেল সেই আলোচিত মাছ বাজারের হিমাগার ও বরফকল।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু ফিস ল্যান্ডিং স্টেশন, এখানে প্রচুর মাছ উঠানো-নামানো হয়। মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফের প্রয়োজন। বোর্ড বিবেচনা করে বরফকল ও হিমাগারের অনুমতি দিয়েছে।’ নির্মাণের দুই বছর পর অনুমতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এজন্য তারা (নির্মাণকারী সংস্থা) দুঃখ প্রকাশ করেছে। মুচলেকা দিয়েছে।’

তবে অনুমতির বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আরেকজন ডিলিং করছে। আমি কিছু জানি না।’ অনুমোদন দিয়েছে উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘হয়তো দু-একদিনের মধ্যেই দিয়েছে।’

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন জানান, ‘যখন কর্ণফুলী নদী তীরের অবৈধ স্থাপনার তালিকা করা হয়েছিল, তখন এ মৎস্য আড়ত ওই তালিকায় ছিল না। এটি কিভাবে কর্ণফুলী নদীর তীরে স্থাপিত হল তা খতিয়ে দেখা হবে। নিউজটি শেয়ার করুন।